সন্ধ্যামালতি
এস এম লিমান
নদীর ধারে ক্ষুদ্রকায় একটি একচালা ঘর। খড় ও টিন দিয়ে ঘেরা, তার একপাশে নাতিদীর্ঘ একটি কাঠের চৌকি। সেখানে নিঃশব্দে-একমনে বসে আদরের ছোট্ট মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছে আলতাফ আলী। তার পাশে ক’জন যাত্রী সময় দেখছে পরবর্তী নৌকার। আলতাফ আলীর ঠিক সামনে হাতখানেক সমান টেবিল, খাতা ও ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে ভাড়ার হিসেব টুকে নিচ্ছে একজন। প্রতিদিন সহস্র যাত্রীর পারাবার তার হিসেবে।
দুই গ্রামের একক সন্ধিস্থল এই নদীঘাট। ২০ মিনিট পরপর যাওয়া-আসা করে নৌকা। তারই এক পালার জন্য প্রতীক্ষায় আলতাফ আলী। ছোট্ট মেয়েটি তার সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ‘অ’ তে “অজগরটি আসছে তেড়ে” বলতে ভীষণ ভয় পায় সে। আদুরে গলায় বলে,
– “আব্বু আমি অজগর সাপ বলব না, আমি ‘অ’- তে অলি বলব, অলি ঊড়ে ফুলে ফুলে। “
আলতাফ আলী আদরে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
– “তা-ই বলিস মা, তুই-ই যে আমাদের একমাত্র অলি।”
গ্রামের একমাত্র স্কুলটি নদীর ঠিক ওপাড়ে। দুপুর গড়িয়ে এলে ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি ফেরার ঢল নামে। ছোটদের তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়ে আসে। বিকেল হতে হতে একে একে সবাই চলে এলো,কিন্তু তার মেয়ের দেখা পাচ্ছেনা সে। প্রতীক্ষা আর যেন সয়না তার। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা। বের হওয়ার সময় পথসম্মুখে দাড়িয়ে পেছন ফিরে বড় মিষ্টি গলায় সে বলেছিল,
– “বাবা তুমি তীরে দাড়িয়ে থেকো আমার জন্য, তোমায় দেখতে দেখতে আসবো নৌকাতে চড়ে। “
আলতাফ আলী ঠিক দাঁড়িয়ে আছে তীরে, সূর্য নীলাভ বিকেল ছেড়ে পশ্চিমে হেলে যায়, কত ফেরি পার হয়ে মেয়ে এখনও এলোনা । ক্রমে গোধূলী লগ্নে রক্তিমাভার বিস্তৃতি ঘটিয়ে ঊর্মীর মাঝে ডুবতে থাকে সূর্য। শেষ ফেরি ঘাটে ভিড়লো। আলতাফ আলী এবার আগ বাড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে দেখে। নাহ, তাকে দেখতে পাওয়া যায়না। বন্দর-ঘাট, নৌকা সব বন্ধ হয়ে যায়, মাঝি-মল্লার সন্ধ্যার ফিরতি কাকদের মতো সারি বেঁধে চলে যায় নিজ নীড়ে। কিন্তু আলতাফ আলী তো যেতে পারে না, সে তখনও দাড়িয়ে থাকে তীরে, তিনি তবুও আশা করে অপাশ থেকে আসা সহসা কোনো চঞ্চল গুঞ্জনের,
– “বাবা?? তুমি আছো তীরে? আমি এসে গেছি।”
আলতাফ আলীর ঠোঁট থেকে অস্ফুট স্বর বেড়িয়ে আসে “হ্যা মা, আমি ঠিক দাঁড়িয়ে আছি।
কেউ আসেনা আর তীরে , আলতাফ আলী দ্রুত পায়ে ফিরতে থাকে বাড়ির পথে, অশ্রুসিক্ত হয়ত তার চোখজোড়া, কিন্তু সাঁঝের আলোর কিঞ্চিৎ প্রতিফলনে তা দেখা যায়না। তিনি আর্তনাদ করতে করতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার মেয়ের কবরের উপর। তীব্র হাহাকার ও বেদনাশিক্ত কন্ঠে তিনি ফেটে পড়েন,
-“তুই কি আর আসবি না মা? আমি যে প্রতিদিন সে ঘাটেই অপেক্ষা করি যেখানে আমাকে দাঁড়াতে বলেছিলি, আমি যে এখনও প্রতিটি কূলে ফেরা তরীর শব্দ শুনতে পাই, শত পা আছড়ে পড়ে তীরে কিন্তু তোর পদধ্বনি পাইনা। মা আমার কেমন আছিস তুই? তোকে যে খুব বুকে নিতে ইচ্ছে করে আমার, আমি কেন গেলাম না সেদিন তোর সাথে সর্বগ্রাসী নৌকাডুবিতে একসাথেই পরপারে যেতাম তবে। অন্তত এ দীর্ঘ প্রতিক্ষার ক্ষত আর বয়ে বেড়াতে হতোনা। মা শুনছিস তুই ?দেখছিস আমাকে?”
রাজকন্যার জন্য সাজানো এই মাটির প্রাসাদ ঘেঁষে ফুটে আছে এক সন্ধ্যামালতি ফুল, অলি এসে ঊড়ে না আর তার পরাগজুড়ে।